বিগ ব্যাং- আসলেই কি ঘটেছিল মহাবিস্ফোরণ?
কোথা থেকে এলো আমাদের এই মহাবিশ্ব? অগুনতি গ্রহ তারা মহাশূন্য এর শুরুই বা কোথায়? নিশ্চয়ই প্রথমে আপনার মাথায় আসলো সেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কাঁপানো বিগ ব্যাং এর মহা বিস্ফোরণের কথা তাইনা? কিন্তু এক্কেবারে সেই আদিতে সেই বিগব্যাং এর সময় আদৌ কি এরকম কোন মহা বিস্ফোরণ ঘটেছিল? আজকের এই ভিডিওতে সেটাই জেনে নেবো হারবার্ট ইউনিভার্সিটির গবেষক সিনক এর বন্ধু জ্যোতির্বিদ শৌনক বোস এর কাছ থেকে। জেনে নেবো আমাদের বিপুল মহাবিশ্বের শুরুর কাহিনী। আমরা এই বিগ ব্যাংগ সম্পর্কে ঠিক কতটা জানি আর কতটুকুই বা এখনো রয়ে গেছে সম্পূর্ণভাবে অজানা।
কোথা থেকে এলাম আমাদের চারপাশের বিশ্ব জগতের উৎপত্তি হলো কীভাবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে চলেছি আমরা সেই প্রাচীনকাল থেকে। পৌরাণিক গল্প ধর্মগ্রন্থে দর্শন চর্চায় এর উত্তর খুঁজার চেষ্টা দেখা যায়। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে এর গভীরে ঘাটা শুরু এইত মাত্র গত শতাব্দীতে হ্যাম বিংশ শতাব্দীর প্রথমে সবাই স্থির বা অপরিবর্তনশীল বিশ্বের ধারনাতেই বিশ্বাস করতেন । অর্থাৎ, আমরা আজকে যেভাবে দেখেছি আগে থেকে সবকিছু ঠিক সেভাবেই চিরটাকাল ধরে একই রূপে বিরাজ করে আসছে। এটাই তো সবচেয়ে সোজা ব্যাখ্যা তাই না? তবে বেলজিয়াম পদার্থবিজ্ঞানী এবং ধর্মযাজক জর্জ
হ্যালডি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব সমীকরণের উপর ভিত্তি করে ১৯২৭ সালে প্রথম প্রস্তাব করলেন, যে সম্ভবত আমাদের মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হয়ে চলেছে। না না ধান ভানতে শিবের গীত গাইছিনা। বিগ ব্যাং এর গল্পের সূচনাতেই ঘটেছিল এ থেকে । তাই মহাবিশ্বের প্রসারণ এর ঘটনাটা না বুঝলে বিগ ব্যাং এর ব্যাপারটা বোঝা সম্ভব নয়, তবে লেমিত্রির প্রকল্পটি তখন কিন্তু তেমন পাত্তাই পেলনা বিজ্ঞানী মহলে। এমনকী আইনস্টাইন নিজেই এর বিরোধীতা করে বসলেন। তবে 1930 সালে আমেরিকার জ্যোতির্বিদ ভেস্টো স্লাইফার এবং এডুইন হাবলের পর্যবেক্ষণ পুরো ঘটনাটিকেই ঘুরিয়ে দিল। তারা তখনকার সবচেয়ে বড় দূরবীন এর সাহায্যে দেখতে পেলেন সবগুলো গ্যালাক্সি আমাদের থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে
অর্থাৎ আমাদের মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে, বড় হচ্ছে, আমাদের থেকে বেশি দূরের গ্যালাক্সি বা ছায়া পথগুলোর থেকে অপেক্ষাকৃত কাছের ছায়াপথগুলোর চেয়ে বেশি গতিতে ছুটছে। মানে যে যত দূরে সে ততই পিছিয়ে যাচ্ছে। তাহলে এবার ফিজিক্স এর নিয়ম মেনে আমাদের মহাবিশ্বের জন্মরহস্যের এই চলচ্চিত্রটাকে রিভাইন করলে দেখা যাবে, যে ছায়াপথগুলো একে অন্যের থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল তারা এখন কাছাকাছি চলে আসতে শুরু করেছে, ঘনত্ব, উত্তাপ, বিকিরন ও বাড়ছে অকল্পনীয় ভাবে। এবার আরো অতীতে যেতে থাকি, যতই সময়ের সেই সুরুর দিকে যেতে থাকবেন ততই সবকিছু গিয়ে যেন এক ছোট্ট বিন্দুতে মিলে যেতে সুরু করবে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে বিগ ব্যাং এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে 14 শ’ কোটি বছর আগে আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখছি, হ্যা সবকিছু গ্রহ-নক্ষত্র, ছায়াপথ, আপনি আমি সব কিছুর উৎস হচ্ছে ক্ষুদ্র পুঞ্জিভূত অসীম শক্তি থাকা একবিন্দু এর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে সিঙ্গুলারিটি। আমরা আমাদের কল্পনায় যতটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভেবে নিতে সক্ষম সিঙ্গুলারিটি 35 বা তার চেয়েও হাজার হাজার গুন ক্ষুদ্র । হ্যা, চট করে পুরো ব্যাপারটা বুঝে ওঠা বেশ কঠিনই বটে। বিগব্যাং মডেল বলছে কোন এক অবস্থায় কোন এক কারন যদিও সেই কারনটি কি ছিল আমরা এখনো তা জানিনা। এই সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টটি খুব দ্রুতগতিতে প্রসারিত হতে শুরু করে এর গতি ছিল অকল্পনীয় রকমে দ্রুত এমনকি আলোর গতি চেয়েও দ্রুত তবে এরকম একটা হোল মোলকে বদলে দেওয়া প্যারাডাম শিফট করা তত্ত্বকে
কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিজ্ঞানীদের কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি বলে দিলেই তো হল না যে পর্যবেক্ষণ এবং গাণিতিক হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে এতদিনের লালিত সমস্ত ধারণা ভুল। আমাদের মহাবিশ্ব আসলে স্থির নয়। তার জন্য সেরকম মাপের প্রমানওত দিতে হবে বরং মজার ব্যাপার হচ্ছে বিগব্যাংগ নামটাও এই বিজ্ঞানীদের কারো দেওয়া নয় বরং স্থিতিশীল বিশ্বের মডেলের প্রবক্তা বিজ্ঞানী হয়েল একবার টিটকারি করে এটা এটা বলেছিলেন আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে বিগব্যাং কথাটা একবারে স্থায়ী ভাবে বশে।
যাই হোক বিগব্যাং এর পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ টা এলো ষাটের দশকের মাঝামাঝি আমেরিকার বেল্লাদে বিজ্ঞানি অ্যালান পেনজিয়াস, রবার্ট উইলসন দূরপাল্লার যোগাযোগের আরো শক্তিশালী যন্ত্র বানানোর জন্য 120 ফুট মাইক্রোওয়েভ এন্টেনা বানিয়ে বায়ুমণ্ডলের বেতার বা রেডিও তরঙ্গ পরীক্ষা করছিলেন কিন্তু রিসিভার চালানোর সাথে সাথে একটা পারপিট.গুনগুন শব্দ শোনা যেতে লাগলো বিরক্ত করে ছাড়লো সেই নাছোর বান্দা গুনগুনানি দিনের পর দিন ধরে এন্টেনা এদিক ওদিক করে বিভিন্নভাবে চালাকি করে পরীক্ষা করেও কিছুতেই তাকে পিছ ছাড়ানো যাচ্ছেনা। ঠিক সেই সময়ই প্রিন্সটেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন বিজ্ঞানীর কাজের সাথে সমন্বয় করে দেখা গেল এটা আসলে কসমি মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা মহাজাগতিক পশ্চাদ বিকিরণ।
তাহলে ব্যাপারটা কি দারাচ্ছে? ধরুন আপনি চা পান করছেন কাপটা প্রথমে খুব গরম ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে তা ঠাণ্ডা হয়ে আসবে। ঠিক সেভাবে মহাবিশ্বের উৎপত্তির শুরুর দিকের অভাবনীয় রকমের উত্তাপ এবং বিকিরন ছিল হয়েছিল সেটা ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আজ মাত্র শূন্যের উপর 2.7 তে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিজ্ঞানিরা আগেই প্রকল্প দিয়েছিলেন বিগব্যাং এর মডেল যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে আকাশ স্ক্যান করে সৃষ্টির সেই সুরুর দিকের ভয়ংকর উত্তাপ এবং বিকিরণের ছিটেফোটা হলেও শনাক্ত করা যাবে। বিগব্যাংয়ের প্রায় 4 লক্ষ বছর পরে যখন ইলেকট্রনের ঘনত্ব কিছুটা কমে আসতে শুরু করে, তা থেকে মুক্তি পায় আলো অর্থাৎ ফোটন ইলেকট্রনের সাথে আর ধাক্কা না খেয়ে বেরিয়ে পড়ে আর তাকেই আমরা দেখছি আজ মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে। ওদিকে আবার এই তাপমাত্রা থেকেই হিসেব করে বের করা যাচ্ছে বিগব্যাং এর পরে কতদিন ধরে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে অর্থাৎ এখান থেকেই আমরা নির্ণয় করতে পারছি এর বয়স। বিজ্ঞানীরা এর পরে বহুদূরের সুপারনোভা গ্যালাক্সির বিস্ফোরণের ওপর ভিত্তি করে এও দেখিয়েছেন যে মহাবিশ্ব প্রসারনের বেগ তো কমছেই না বরং ক্রমশ বেড়ে চলেছে।.
বিগব্যাং এখন আর শুধু একটা ধারণাই নয় এটা আমাদের মহাজাগতিক উৎসের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব। মহাবিশ্ব মহাশূন্য যে অনবরত প্রসারিত হচ্ছে এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এতক্ষণ তো দেখলাম বিগ ব্যাং তত্ত্ব কি শেষ করার আগে সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক আমরা এখনো এ সম্পর্কে কি কি জানি না এবং কি কি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে এ নিয়ে। সেই যে প্রথমে বলেছিলাম বিগব্যাংয়ের কথা শুনলেই আমাদের প্রথমে এক গগন বিদারি বিস্ফোরণের কথা মনে পরে, যেন হাজার হাজার মহাশক্তিশালী নিউক্লিয়ার বোমা ফাটছে, সমগ্র মহাশূন্য জুড়ে না আসলে বিগব্যাংয়ের সময় এরকম কোন মহাবিস্ফোরণ ঘটেনি এটা মহাবিশ্বের প্রসারণ এর প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়.
এখন বিগব্যাং কে যদি সময় শুন্য বলে ধরি তাহলে বিজ্ঞানীরা সেখান থেকে 10 টুদি পাওয়ার নেগেটিভ 43 সেকেন্ড পর্যন্ত কি ঘটেছিল তা এখনো ব্যাখ্যা করতে পারেন না। কিন্তু উদ্ভট রকমের এই ছোট্ট সময় নিয়ে হিসেবটা দিয়ে আসলে কি বোঝা গেল? বোঝা গেল আমাদের মহাবিশ্বের বয়স এখন 1370 থেকে 1380 কোটি বছরের মতো আর আমরা তার প্রথম এক সেকেন্ডের মিলিয়নের 10 ভাগের ট্রিলিয়ন ভাগ এর ট্রিলিয়নের উপরে আর এক ট্রিলিয়ন সেকেন্ড সম্পর্কে এখনো জানিনা। ওদিকে আবার বিগ ব্যংক শব্দটা থেকে বা আমাদের গ্যালাক্সি দেখে মনে হতে পারে যে কোন একটা বিন্দুকে কেন্দ্র করেই যেন এই মহা বিস্ফোরন টা ঘটেছিল। কিন্তু আসলে কি আমাদের মহাবিশ্বের কোন কেন্দ্র আছে? না নেই, এবং কারন টাও
বেশ সহজ, বিগব্যাং এর আগে সময় এবং স্থানের কোন ধারনাই ছিলনা। এখনো সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিত না হলেও বিজ্ঞানিরা মনে করেন যে বিগব্যাং এর পরে দশ টুদি পাওয়ার নেগেটিভ 36 থেকে দশ টুদি পাওয়ার নেগেটিভ ৩৩ সেকেন্ড পর্যন্ত মহাবিশ্ব অকল্পনিয় গতিতে সম্প্রসারিত হয়েছিল। যাকে বলে Inflation, আর ইনফ্লুয়েশন তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্বের স্ফিতি থেমে গেলেও বহুদূরে কোথাও কোথাও inflation থামেনি হয়েই চলেছে। আর সেজন্যই প্রায় অসীম এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু খোঁজার আসলে কোন অর্থ হয় না।
তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হতে থাকলে, শেষটায় কী হবে? গ্রহ,, নক্ষত্র ছায়াপথ সব বহু দূরে দূরে সরে যাবে একে অন্যের থেকে। তারাদের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে আসবে ধীরে ধীরে। একদিন একে একে তারাও নিভে যাবে, তারপর গোটা মহাবিশ্বের তাপ আর আলো শেষ হয়ে গেলে ফুরোবে মহাজাগতিক সব লেনদেন। সেসবের হিসেব নিয়ে আসবো ভবিষ্যতে শোনাবো অনু পরমানু এই বস্তু জগতের গল্প। ডার্ক ম্যাটার ইনফ্লিকসেন সিঙগুলারিটি প্রথম সেই মূহুর্তের বিষয় গুলো নিয়ে বিজ্ঞানিদের চিন্তাভাবনা নিয়ে রোমাঞ্চকর সব গল্পগুলো।